কনট্রাক্টরের চৌথা

নোট: এই লেখাটা একরকম রিভিউ হইলেও, এইটা সিরিজ লিখা হইতে পারে – নাও হইতে পারে। হুজুর বলছেন লিখতে তাই শুধু সিনেমা নিয়া লিখা আসবে এমন কিছু না। (এখানে দু লাইন ফাঁকা জায়গা) উলটাপালটা ভাবনা, এলাকার ইট-বালি, দিনমজুরের কাম, করলার দাম, পলিটিক্সের ঠেলাঠেলি, নয়তো হঠাৎ কোন কন্সট্রাকশন সাইটের এক কোণায় দাঁড়ায়া চৌথার পাতায় টোকা দেয়া একটা লাইন—এইসব মিলাইয়া যা দাঁড়ায়, এইডাই সেই লেখা।

Faya Dayi (2021) নিয়া কই—এইটা ডকুমেন্টারি হইলেও ঠিক ডকুমেন্টারি যেমন হয় আরকি তেমন না। জেসিকা বশির এমন একটা ছবি বানাইছে যেটা দেখলে, গাওগেরাম দেখতেছি—মনে হয়। ইথিওপিয়ার কুয়াশায় ভরা মাঠ, হুজুগে মাটি, খাটপাতা চাষি—এইসব দিয়া বানাইছে একধরনের ঘোর। খাট অনেকটা তামাক এর মতো। নেশা আবার নেশা না।

এই সিনেমার রঙ কালা-সাদা, মেঘ বৃষ্টি গুমরা, খাট পাতার রঙ নাই এই সিনেমায়। খাটের চাষের কথা থাকলেও, গল্প খালি ওইটা না সেইডা সহজেই টের পাইয়া যাবেন। আস্তে আস্তে ছবিটা গায়ে গায়ে জড়ায়, হাড্ডি-মাংসের হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে বসে ছবিটা দেখে মনে হইল, আরে এইটা তো সিলেটের চা-বাগানেরই একটা উল্টা আয়না। আমরা যেইখানে দেশ আছি অর্থনীতি লইয়া ঠ্যালায়, রাজনীতি লইয়া যাঁতায়, সেইখানে এই ছবি যেন আরেক দিক দিয়া কথা কয়। সিলেটের চা বাগান তো আসলে এমনই মনে হইতে পারে।

বশির কোনো তথ্যের হ্যান্ডনোট দেয় নাই। কেউরে বুইঝায় না, লেখালেখি-পড়ালেখি, ভারি ভারি চিন্তা ঠ্যাইলা দেয় না। ক্যামেরা নিয়া হাঁটতে হাঁটতে কুয়াশার ভিতর ঢুকাইয়া ফেলে। সুফি গানের ঢেউয়ের লগে, চাষির ক্লান্ত হাতের মুভমেন্ট, মাটির গন্ধ—সব মিলাইয়া যেন চোখ না, হুঁশ দিয়া ছবি টের পাওয়া যায়।

খাটপাতা তোলা হাতগুলা নাচে ক্লান্ত ডেহুন্নির মতো। পেছন দিয়া ভেসে আসে হালকা আওয়াজ—কারো দুঃখ, কারো স্বপ্ন, কেউবা কয় ‘দুবাই যামু’। ছবিটা দেখা মানেই দেখা না—এইটা একধরনের হাওয়ায় ভেসা, খাটের নেশা মতো লাগা এক অভিজ্ঞতা।

আমরার জন্য সবচেয়ে টানবে, যেইখানে খাট চাষিরা বাধা পইড়া গেছে এই চাষে—কেনো? কারণ দুনিয়ার বাজার তাদের আর কোন রাস্তা দেয় নাই। ঠিক যেইভাবে আমরার চা-বাগানের চাষি, চা পাতা ডলতে ডলতে হাতের দিকে চাইয়া থাকে ভাত খাওয়ার জন্য, আর মালিকের লগে দর কষাকষি করে কিন্তুক মালিক থাকে ঢাকা – তাঁরার আলাপ যাইয়েই না অই পর্যন্ত।

একটা পুরান মসজিদে জুমার নামাজ হইতেছে। ওইখানেই বোঝা যায়—এই ছবি খাট নিয়া যতটা, ততটাই বিশ্বাস নিয়া। যেই দুনিয়া ভাইঙা পড়তেছে, সেখানে মানুষ বিশ্বাস দিয়া মাথা বাইন্ধা রাখে, বাঁচার উপায় খোঁজে – লগে পাছে সুফিবাদি সেই বিশ্বাস, খোঁদা আছেন, দেখতাছেন।

বশির নিজে একজন নারী নির্মাতা, এইটা কিন্তু সিনেমা দেইখা টের পাবেন না, নেটে ঘাইটা বাইর করতে হবে – সিনেমাটা ‘একজন নারীর নির্মাণ’ এমন কিছু ধরা পরে নাই। মুসলিম প্রধান সমাজ থেইকা উঠে আসছেন ডিরেক্টর। এইটা খুব গভীর অ কঠিন আলাপ। দেশে যেমন দেখি—সিনেমা বানাইতে গিয়া কতো কাঠখড় পুঞ্জি পুড়াইতে হয়, ফান্ড পাওয়া যায় না, অনুদান নিয়া কামড়াকামড়ি, গল্প কার এইটা নিয়াও লড়াই, ওটিটি রিলিজ আরো কত আলাপ।

কিন্তু বশির ওইসব ধারার না মনে হইল। রেটিং ফেটিং ধরতে যাইয়েন না। বরং সুফি গান দিয়া প্রতিবাদ করতেছে, সেইটা পাইতে পারেন। গানের ভিতর দিয়া বলে দেয়—এইটা শুধু সিনেমা না, এইটা অবস্থান। ধর্ম আর আন্দোলনরে এক জোড়, ছবির ভিতর দিয়া একটা আস্ত জবানবন্দি দাঁড় করায়। এই … এতটুকুই। বিদায়।


পার্বণ মাজহার
গ্রাফিক ডিজাইন করি, ফিল্ম বানানির সাথে থাকি, মাঝেমধ্যে কন্সট্রাকশনের সাইটেও কঞ্চি হাতে দাঁড়ায়া থাকি, কয়েকদিন আগে রঙ মিস্ত্রীগিরি করছি।
ইমেল: contactparbon@gmail.com