সিনেমার শতবর্ষে জোনাস মেকাসের সিনেমা-বিরোধী ইশতেহার

প্যারিসের আমেরিকান সেন্টারে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে জোনাস মেকাস এই বক্তব্যটি দেন। ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত Point d’ironie-তে ১৯৯৭ সালে লেখাটি প্রথম প্রকাশ পায়। সিনেমার শতবর্ষ উদযাপনের ধারা ও বিজ্ঞাপণের প্রতি জোনাস মেকাস এর প্রতিক্রিয়া রুপ হিসেবে এই ইশতেহারটির আবির্ভাব।

আমাদের জানাই আছে ঈশ্বর এই পৃথিবী ও পৃথিবীর মাঝের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং এই সৃষ্টিযজ্ঞের সবই খুব মহৎ। সমস্ত কবি, চিত্রকর এবং মিউজিশিয়ান তাদের কর্মে ঈশ্বরের সৃষ্টিকর্মের গুণকীর্তন গেয়েছেন এবং এই সবই আপাতভাবে ঠিক ছিল। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এসব মাধ্যমে সৃষ্টির গুণকীর্তনে ঈশ্বর এক অদ্ভূত অভাববোধ করছিলেন। তাই একশ বছর আগে ঈশ্বর ঠিক করলেন তিনি চলমান চিত্রধারণের জন্য একটি ক্যামেরার সৃষ্টি করবেন। তিনি তাই করলেন এবং সাথে সৃষ্টি করলেন একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং বললেন, “এই যন্ত্রটা হল চলমান ছবি ধারণ করার একটি যন্ত্র। এটি নিয়ে যাও, আমার সৃষ্টিযজ্ঞ ও মানবজাতির অন্তরাত্মার সুঘ্রাণবেষ্টিত সৌন্দর্যের উদযাপন করো আপন মনের রং-রস মিলিয়ে।“

কিন্তু ঈশ্বরের এমন নিঃস্বার্থ বর পছন্দ হল না সন্নিকটস্থ অপদেবতার। তাই সে টাকা ভর্তি একটি ঝুলি রাখল সেই চলচ্চিত্র নির্মাতার সামনে এবং বলল, “কেন চাইছো এই যন্ত্র দিয়ে পৃথীবির সৌন্দর্য ও অন্তরাত্মার উদযাপন করতে যখন তুমি চাইলেই এই যন্ত্র দিয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা উপার্জন করতে পারো?” বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, সেই চলচ্চিত্র নির্মাতার পথ অনুসরণ করেছিল আরো বহু নির্মাতা যারা একি ভাবেই সেই টাকা ভর্তি ঝুলিটার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। ঈশ্বরের বোধ হল যে তিনি একটি ভুল করে ফেলেছেন। তাই এই ভুলের মাশুল বশত পচিশ বছর বাদে তিনি সৃষ্টি করলেন একদল স্বাধীন, সম্মুখবর্তী আভা-গার্ডে চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং বললেন, “এই নাও ক্যামেরা এবং বেরিয়ে যাও পৃথিবীর সৃষ্টির গুণকীর্তনে নিজের মত করে। কিন্তু, তোমাদের সামনে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে এবং এই যন্ত্র দিয়ে তোমরা একটি পয়সাও কামাতে পারবে না।“

ঈশ্বর এভাবেই যাদের সাথে কথা বলেছিলেন তারা হলেনঃ ভাইকিং এগেলিং (Viking Eggeling), জার্মেইন দ্যুলেক (Germaine Dulac), জ্যঁ এপস্টেইন (Jean Epstein), ফার্নান্দ লেগার (Fernand Léger), দিমিত্রি কির্সানোফ (Dmitri Kirsanoff), মার্শেল দ্যুশেম্প (Marcel Duchamp), হ্যান্স রিকটার (Hans Richter), লুই বুনুয়েল (Luis Buñuel), ম্যান রে (Man Ray), কাভালকান্তি (Cavalcanti), জ্যঁ ককটো (Jean Cocteau), মায়া ডেরেন (Maya Deren), সিডনি পিটারসন (Sidney Peterson), কেনেথ এংগার (Kenneth Anger), গ্রেগোরি মার্কোপোলোস (Gregory Markopoulos), স্ট্যান ব্রেকহাজ (Stan Brakhage), ম্যারি মেনকেন (Marie Menken), ব্রুস বেইলি (Bruce Baillie), ফ্রান্সিস লি (Francis Lee), হ্যারি স্মিথ (Harry Smith), জ্যাক স্মিথ (Jack Smith), ক্যান জ্যাকবস (Ken Jacobs), আর্নি গেহর (Ernie Gehr), রন রাইস (Ron Rice), মাইকেল স্নো (Michael Snow), জোসেফ কর্নেল (Joseph Cornell), পিটার কুবেলকা (Peter Kubelka), হলিস ফ্রেম্পটন (Hollis Frampton), বারবারা রুবিন (Barbara Rubin), পল শ্যারিটস (Paul Sharits), রবার্ট বিভারস (Robert Beavers), ক্রিস্টোফার ম্যাক্লেইন (Christopher McLaine), কার্ট ক্রেন (Kurt Kren), রবার্ট ব্রিয়ার (Robert Breer), ডোরি অ (Dore O), ইসিডোরি ইসোউ (Isidore Isou), এন্টোনিও দে বার্নান্দি (Antonio De Bernardi), মরিস লেমেত্রি (Maurice Lemaître), ব্রুস কনার (Bruce Conner), ক্লস উইবর্নি (Klaus Wyborny), বরিস লেহমেন (Boris Lehman), ব্রুস এল্ডার (Bruce Elder), তাকা ইমুরা (Taka Iimura), আবিগাইল চাইল্ড (Abigail Child), এন্ড্রু নরেন (Andrew Noren) এবং আরো অনেকেরই সাথে। তারা তাদের বোলেক্স, এইট মিলিমিটার এবং সুপার এইট মিলিমিটার ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর সৌন্দর্যধারণ এবং মানবজাতির দুঃসাহসিক অভিযান এর চিত্রধারণে। তারা যথেষ্ঠ মজা পাচ্ছিল এ কাজে। কিন্তু, এই ফিল্মগুলো তাদের অর্থকড়ির সন্ধান দিচ্ছিল না এমনকি প্রচলিত অর্থে “প্রয়োজনীয়” কিছুরও সন্ধান দিচ্ছিল না তাদের জীবনে।

যখন পৃথিবীব্যাপী জাদুঘরগুলো সিনেমার একশ বছর উদযাপন করে চলেছে কোটি কোটি টাকা খরচ করে, সবাই আসলে হলিউডকে নিয়ে চূড়ান্তভাবে মেতে উঠেছে আবারো। কিন্তু, সিনেমার শতবর্ষ উদযাপনে কোথাও স্বাধীন অথবা আভা-গার্ডে চলচ্চিত্রের উল্লেখ নেই।

পৃথিবীব্যাপী মিউজিয়াম, আর্কাইভ এবং সিনেমাথেকের ব্রশিওরগুলো চোখে পড়ছে আমার এবং তারা যেন গর্ব ভরে বলছে, “আমরা তোমাদের সিনেমাকে গ্রাহ্যও করি না।“ এই সময়ে এসে কোটি কোটি টাকা খরচ করা, জাকজমকে ভরা, প্রদর্শণীমূলক সিনেমার সময়ে আমি জয়গান করতে চাই মানবাত্মার ক্ষুদ্র, অদৃশ্য, কাব্যিক ক্রিয়াকর্মের যা এত নিগূড়, ক্ষুদ্র ও সংবেদনশীল যে, আলোর স্পর্শে এলেও এই স্বত্তা আহত-চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। আমি তথাকথিত ক্ষুদ্র গড়ণ ও বিন্যাসের সিনেমার গুণকীর্তণ করতে চাই যার মাঝে কাব্যিকতা আছে, গীতিময়তা আছে; যেই সিনেমা হতে পারে জলরং এর মত, একটি স্কেচ কিংবা পোর্ট্রেটের মত, এক যন্ত্রে বাজানো একটা ছোট গানের সুরের মত, একটা নৃত্যের ভংগিমার মত, কিংবা একটি এইট মিলিমিটার গীতের মত। এমন একটা সময়ে যখন সবাই সফলতা চায় কিংবা বিক্রী হয়ে যেতে চায়, আমি তাদের গুণগাণ গাইতে চাই যারা তাদের ফিল্মের মাধ্যমে দৈনন্দিনতা ও সামাজিকতার বহির্বাসকে আলিংগণ করে একটা অদৃশ্যতাকে তুলে আনতে চায়। আমি সেই ব্যক্তিগত ফিল্মের পক্ষ নিতে চাই যা কোনো পয়সা উপার্জন করতে পারে না, খাদ্যের যোগান দিতে পারে না কিংবা কোনো সমসাময়িক ইতিহাস, শৈল্পিক ইতিহাস বা কোনো ধারার ইতিহাসই তৈরি করতে পারে না। আমি এমন শিল্পের পক্ষে যা আমরা বন্ধু হিসেবে একে অপরের জন্য করি।

আমি একটি ইনফরমেশন হাইওয়ের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছি এবং হেসে যাচ্ছি কারণ, ঠিক একি সময়ে চীনের কোথাও হয়ত একটি ছোট ফুলের ওপর একটি প্রজাপতি এসে তার পাখা মেলে দিয়েছে এবং আমি বিশ্বাস করি এই পাখা ঝাপটানির কারণে সমগ্র ইতিহাস, সংস্কৃতি মারাত্মকভাবে বদলে যাবে।ঠিক এমনই, একটি সুপার এইট মিলিমিটার ক্যামেরা পৃথিবীর কোথাও হয়ত তার ক্ষীণ চলন-গুঞ্জণ চালিয়ে যাচ্ছে, হয়ত নিউইয়র্কের লোয়ার-ইস্ট-সাইড এলাকায় এবং ক্যামেরাটির এই মুহুর্তের গুঞ্জণের কারণে পৃথিবীর চলন-বলন-সংস্কৃতি চিরতরে বদলে যাবে।

আমার মতে, সিনেমার প্রকৃত ইতিহাস হল এক অগোচর ইতিহাসঃ বন্ধু-সকলের কোনো এক স্থানে এক হওয়া, যার যা ভাল লাগে তাতে মত্ত হওয়ার এক বিস্তৃত উপাখ্যান। আমাদের জন্য, সিনেমা আবার গা ঝাড়া দিয়ে নবযাত্রা আরম্ভ করছে প্রজেক্টরের ঘটঘট প্রতিটি শব্দের মাধ্যমে, আমাদের ক্যামেরার প্রতিটি শাটারের শব্দের মাধ্যমে। আমাদের ক্যামেরার প্রতিটি শব্দ-গুঞ্জণ এর সাথে আমাদের হৃদয়-গুঞ্জণও সামনে এগিয়ে আসে, বন্ধুরা।

অনুবাদ: ফজলে হাসান শিশির